
মোশাহেদ চৌধুরী●
দেশের জীবন বীমা খাতে এক উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। নিয়মিতভাবে বীমার কিস্তি পরিশোধ করেও পলিসি মেয়াদ শেষে গ্রাহকদের তাদের ন্যায্য টাকার জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এই খাতের ভয়াবহ পরিস্থিতি উন্মোচন করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৩২টি জীবন বীমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের আটকে থাকা দাবির মোট পরিমাণ ৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকারও বেশি।আইনের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে যে, বীমার মেয়াদ পূর্তির পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যেই গ্রাহকের দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে, বাস্তবে বেশিরভাগ জীবন বীমা কোম্পানি এই নিয়ম মানছে না। এমন অনেক গ্রাহক রয়েছেন যারা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের ন্যায্য টাকা পাওয়ার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, কিন্তু কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না।আইডিআরএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই বকেয়া দাবির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এই অঙ্ক অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা মনে করছে, মূলত আর্থিক অনিয়ম, কোম্পানির সম্পদ লোপাট এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেই এই কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের দাবি পরিশোধে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে কয়েকটি নির্দিষ্ট কোম্পানির ক্ষেত্রে। আইডিআরএ-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রাহকদের আটকে থাকা মোট দাবির প্রায় ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি। এর মধ্যে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে আটকে থাকা দাবির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ৫৯৯ কোটি টাকা। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই কোম্পানির ৯৮ শতাংশের বেশি দাবি এখনও পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়নি। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, যার কাছে গ্রাহকদের ২৯৪৬ কোটি টাকা আটকে আছে; পদ্মা ইসলামী লাইফের কাছে ২৬১ কোটি টাকা; বায়রা লাইফের কাছে ৮৩ কোটি টাকা এবং প্রগ্রেসিভ লাইফের কাছে ২০১ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে থাকায় অসংখ্য গ্রাহক আর্থিক কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন এবং জীবন বীমার প্রতি তাদের আস্থা ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে।এই পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, গ্রাহকদের ন্যায্য টাকা সময়মতো না পাওয়ায় বীমার প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই খাতের সার্বিক বৃদ্ধিতে। এক দশক আগেও দেশের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান প্রায় ১ শতাংশ ছিল, যা বর্তমানে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে মাত্র ০.৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে, গ্রাহকদের আস্থা হারানোর কারণে বীমা খাত কতটা পিছিয়ে যাচ্ছে।বীমা খাত সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মনে করেন, এই সংকট মোকাবিলায় আইডিআরএকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অনিয়মকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, এমনকি প্রয়োজনে তাদের লাইসেন্স বাতিল করার মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবই আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।তবে, এই হতাশাজনক চিত্রের মাঝেও কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। পপুলার লাইফ, ট্রাস্ট ইসলামী, চার্টার্ড লাইফ, সোনালী লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, সন্ধানী লাইফ, মেঘনা লাইফ এবং রূপালী লাইফের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের বীমা দাবির ৯৯ শতাংশের বেশি পরিশোধ করেছে। এই কোম্পানিগুলো প্রমাণ করে যে, সততা, স্বচ্ছতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করা এবং সময়মতো তাদের দাবি নিষ্পত্তি করা সম্ভব।আইডিআরএ স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, “কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম পুরো খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।” নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইতোমধ্যে এই সমস্যা সৃষ্টিকারী কোম্পানিগুলোকে গ্রাহকের দাবি পরিশোধের জন্য তাদের সম্পদ বিক্রি করার নির্দেশ দিয়েছে। তবে, এই নির্দেশ কতটা কার্যকর হবে এবং গ্রাহকরা কবে তাদের ন্যায্য টাকা ফেরত পাবেন, তা নিয়ে এখনও সংশয় রয়েছে।জীবন বীমা খাতে গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে অবিলম্বে দাবি পরিশোধে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ-কে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্যথায়, দেশের বীমা খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ এবং বিশ্বাস ক্রমাগতভাবে কমতে থাকবে, যা অর্থনীতির জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। ●ট