
এস.বি-সুজন, লালমনিরহাট :
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৪ বছর পর প্রথমবারের মতো লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চল তথা বাঘমারীর চরে পা রাখলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) এলাকার মানুষের মুখে হাসি ফোটানো এই মুহূর্তটির সাক্ষী হন হাতীবান্ধার ইউএনও শামিম মিঞা। এই নদীবেষ্টিত চরে প্রবেশ করা সহজ নয়।
সড়ক যোগাযোগ নেই, আধুনিক যানবাহনও চলে না। বাইসাইকেলই এখানকার প্রধান বাহন। সেই বাধা পেরিয়ে ইউএনওর আগমন যেন ঈদের খুশির মতো ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে।
আমিই প্রথম ইউএনও’ স্মৃতিতে নেই কারও আগমন
ইউএনও শামিম মিঞা নিজেই জানান, “জিজ্ঞেস করলাম, স্বাধীনতার আগে-পরে কেউ কি এখানে এসেছিলেন? কিন্তু কেউই এমন কিছু মনে করতে পারলেন না। তার মানে, হয়তো আমিই প্রথম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যিনি এই চরাঞ্চলে এসেছি। বাস্তবতা হলো, জায়গাটি এতটাই দুর্গম যে এখানে না আসাই যেন স্বাভাবিক। ”তিস্তা ব্যারাজের পেছনে, ডিমলা উপজেলার সীমান্তঘেঁষা এই পার শেখসুন্দর গ্রামটিই হাতীবান্ধা
উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় অপ্রতুল। যাওয়া-আসায় ইউএনওসহ কর্মকর্তাদের হেঁটে ও ট্রাক্টর এবং নৌকা ঠেলে পাড়ি দিতে হয়েছে প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ।
প্রস্তুতিতে ঈদের আনন্দ, অতিথিকে বরণে উচ্ছ্বাস
ইউএনওর আগমনের খবর পেয়ে গ্রামবাসীরা তিন দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের নতুন পোশাক পরানো হয়েছে, তৈরি হয়েছে প্যান্ডেল, বসানো হয়েছে ফ্যান, সাউন্ড সিস্টেম। একজন সরকারি কর্মকর্তার উপস্থিতি এই গ্রামের মানুষের কাছে যেন উৎসবের আনন্দ।
স্কুলে শিক্ষকের অভাব, জীবন পেরিয়ে আসে শিক্ষিকা
২০০৬ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। প্রধান শিক্ষক পাশের জেলা জলঢাকার বাসিন্দা। ২০০৯ সাল থেকে দায়িত্বে আছেন তিনি। এমনও সময় গেছে, গলা পর্যন্ত পানি পেরিয়ে এসে পোষাক পরিবর্তন করে ক্লাস নিয়েছেন। বর্তমানে তিনজন শিক্ষক দিয়ে স্কুলটি কোনোভাবে চলছে কিন্তু তার মধ্যেও একজন বদলির আবেদন করেছেন। একমাত্র নারী শিক্ষিকা একবার পানির স্রোতে ভেসে যেতে যেতে রক্ষা পেয়েছেন।
স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা একজন CHCP
এখানে একটি মাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, সেখানেও একজন মাত্র কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার ( CHCP ) দায়িত্বে আছেন। তিনিই স্থানীয় বাসিন্দা, লালমনিরহাট সরকারি কলেজে মাস্টার্সে পড়ছেন। স্কুলজীবনে প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হয়েছে তাকে। তার সংগ্রাম, তার অধ্যবসায়, এ প্রজন্মের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা। তবে বিদ্যুতের লাইন কেটে যাওয়ায়, ক্লিনিকে থাকা ফ্যান বা প্রেশার-ডায়াবেটিস মাপার ডিজিটাল যন্ত্রও বন্ধ হয়ে গেছে। লাইনম্যান নাকি সেদিনই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গেছেন।
গ্রামীণ উন্নয়নে সরকারি প্রতিনিধি দল, বাস্তবায়নে আশাবাদী ইউএনও
গ্রামের মানুষের কথা শোনার জন্য ইউএনও শামিম মিঞা সঙ্গে নিয়েছিলেন উপজেলা প্রকৌশলী ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা উত্তম কুমার নন্দীকে। তাদের সরেজমিনে বাস্তব পরিস্থিতি দেখানো হয়েছে যেন এলাকাবাসীর প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া যায়। গ্রামবাসীরা নিজেরা পরিশ্রম করে প্রায় আড়াই কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেছেন। এখন দরকার কিছু কালভার্ট ও একটি ছোট ব্রিজ। সরকারি সহায়তা পেলে তারা এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।
শস্যের সাথে আশার চাষ
এই জনপদের মানুষগুলো পরিশ্রমী ও আত্মনির্ভরশীল। ধান, ভুট্টা, পেঁয়াজ, রসুনসহ নানা ফসল ফলিয়ে তারা সারা বছর ব্যস্ত থাকেন। বাচ্চাদের অনেকেই থাকে দূরের আতœীয়দের বাড়িতে। কারণ এই দুর্গম এলাকায় স্কুলে পাঠিয়ে সারাদিন চিন্তায় কাটে পানিতে পড়ে যাবে না তো?
তবু তারা আশাবাদী
এই গ্রাম ও তার মানুষগুলো যেন আলো-ঝলমলে জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক টুকরো প্রতিচ্ছবি। কঠিন বাস্তবতা সত্ত্বেও তারা আশাবাদী, তাদের বিশ্বাস কোনো পরিশ্রম বৃথা যায় না। ইউএনও বলেন, “তাদের গল্প শোনার পর মনে হয়, আমরা যতটা সন্দিহান উন্নয়ন সম্ভব কিনা, তার চেয়ে তারা অনেক বেশি বিশ্বাস করে।” এই মানুষগুলোর জীবন কষ্টে ঘেরা, কিন্তু তাতে কোন গ্লানি নেই আছে আত্মমর্যাদা আর সাহসিকতার গল্প। এই গল্পগুলোই একদিন গড়ে তুলবে বাংলাদেশের উন্নয়নের অনন্য দলিল।