
বাদশা প্রমানিক , ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি :
ভারতের গজল ডোবা ব্রিজের সবগুলো জলকপাট খুলে দেয়ায় উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি হয়ে বিপদ সীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সন্ধ্যা ছটায় পানি কমতে শুরু করেছে যা বিপদ সীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া পানির প্রবাহে তিস্তা নদীর চ্যানেল তৈরি হয়ে নতুন নদীর সৃষ্টি হয়ে সহস্রাধিক একর আমন ক্ষেত সহ আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফসলী জমি হারিয়ে হাজারো কৃষক সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছে । বন্যা কবলিত এলাকা ও ভাঙ্গন কবলিত এলাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইমরানুজ্জামান ও জেলা ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান,বন্যা কবলিত সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গন ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা জমা দিয়েছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বরাদ্দকৃত চাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ শুরু করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত চাল অপ্রতুল হওয়ায় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে আরও ১৫ টন চাল বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।
নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার বুধবার সন্ধ্যায় বিপদ সীমার ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও পানি বৃদ্ধি পেয়ে বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায় বিপদ সীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয় কালকে । এতে নিম্নাঞ্চল ও চরগুলো তলিয়ে গেছে। চরবাসীরা গবাদিপশু ও মালপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে গেছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সকাল ৬টায় পানির সমতল রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ২০ মিটার, যা বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপরে। এ পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয় ৫২ দশমিক ১৫ মিটার। বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় পানির প্রবাহ ৫২ দশমিক ৩২ সেন্টিমিটারে দাঁড়ায়। যা বিপদ সীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে চতুর্থবারের মতো তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এর আগে ২৯ জুলাই রাতে প্রথমবার ৭ সেন্টিমিটার, ৩ আগস্ট ৪০ সেন্টিমিটার এবং ১২ আগস্ট ১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এবার চতুর্থবারের মতো বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায় বিপদ সীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপরে যা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই, পূর্ব ছাতনাই, খগাখাড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে ।
ইতিমধ্যে খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য তফেল মেম্বারের বাড়ির পাশ দিয়ে নদীর একটি নতুন শাখা সৃষ্টি হয়ে সহস্রাধীক একর আবাদি জমি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে । এতে শতাধিক পরিবার গৃহহীন ও ভূমিহীন হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে নিরাপদের জন্য আত্মীয়ের বাড়ি কিংবা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান ,গত কয়েক বছরে তিস্তার ভাঙনে অসংখ্য গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা ও খেলার মাঠসহ বহু স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়েছে। এবারের ভাঙনের তীব্রতা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে । প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার একর ফসলি জমি ও নদীপাড় ভেঙে যাচ্ছে, যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , বাজার ও ঘাট ঝুঁকিতে রয়েছে।
টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন জানান, তাঁর ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ড নদীর তীরবর্তী। সেখানে কয়েক হাজার মানুষের বসবাস করে , এর মধ্যে প্রায় সহস্রাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘরে পানি উঠেছে।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝড়সিংহেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা বিনোদ আলী বলেন, ‘পানি বেড়ে চরগুলো ডুবে গেছে। অধিকাংশ মানুষ লোকালয়ে চলে এসেছে, গবাদিপশুর জন্য খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।’
খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রামের আব্দুল মালেক জানান, ‘প্রতিদিনই পানি বাড়ছে। মানুষ নৌকায় করে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে—কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ ভাড়া বাসায় উঠছেন। যাদের গবাদিপশু আছে তারা বেশি বিপাকে পড়েছেন, অনেক পশু এখনও চরেই রয়ে গেছে।’
গয়াবাড়ি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি সদস্য বাবর আলী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় নদীর তিনটি শাখা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক আবাদি জমির ধান তিস্তার পানিতে তলিয়ে গেছে। নদীর ওপারের কয়েকটি চর ডুবে গেছে, অনেকের বাড়ির কাছাকাছি পানি চলে এসেছে। গবাদিপশু সরানো নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ।’
তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টের পানির লেভেল পরিমাপক নুরুল ইসলাম জানান, ‘উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তবে পানি কমতে শুরু করায় সন্ধ্যা ছ টায় পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় বিপদ সীমার ১১সেন্টিমিটার উপরে।পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪ টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান জানান, বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দুর্গতদের জন্য ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ মে, টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেগুলো ইতিমধ্যে বিতরণ শুরু হয়েছে। আবারো ১৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শুকনো খাবার, ত্রাণসামগ্রী ও তাঁবু মজুত রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যেই বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে এবং ভাঙন প্রতিরোধে জিও ব্যাগ ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী সালামত ফকির বলেন, ‘উজানের ঢলে ও অব্যাহত প্রবল বর্ষণের কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে । তিস্তার তীরবর্তী বাসিন্দাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে সতর্ক থাকতে ।